পৃষ্ঠাসমূহ

জীবন যখন শিল্পময় হয়ে ওঠে

জীবন যখন শিল্পময় হয়ে ওঠে 
মাঈন উদ্দিন জাহেদ 
.
জীবন ও বোধের সাথে যারা প্রতারণা করেননি তারা তারা মহাকালকে ছুঁয়ে গেছে আপন সততায়। সেই সততার হৃদয় ভাষ্য কাসিক হয়ে টিকে আছে মহাকালের ধূলো উড়িয়ে। সততার এ নির্মম রূঢ়তা তাদের গড়ে তুলেছে নিখাদ শিল্পী, নৈপূণ্যের কারিগর, পেয়েছে তারা হৃদয়ের বন্ধুতা। জীবনের পলে পলে যারা বোধকে ঘষে মেজে নির্ভার করেছেন তাদের মূহুর্তমালার অনুণের কষ্ট কেউ কি আলতো ছুঁয়ে দেখেছেন? দেখেছে কি কেউ তলস্তয়ের এক একটি গল্প উপন্যাসের ঘটনার পেছনে অনুঘটনাগুলো কী? 
.
উপমা হিসেবে যখন তলস্তয় আসলোই তাহলে প্রসঙ্গটাও টানা যাক্। শিল্প কী এ নিয়ে নানান তর্ক ও ভাষ্য রয়েছে। এমন কী এ নিয়ে মহা মনীষী লেভ তলস্তয়ও ভেবেছেন বিস্তর। তার উপন্যাস ও গল্পের অরায়নের পেছনেও অনেক যুক্তি তর্কের রক্তরণ চলেছে হৃদয় ও মননে। কৈশোর থেকে প্রৌঢ়ত্বের কিংবা প্রান্ত বয়সে যখন তিনি জমিদারী ছেড়ে ছুড়ে চলে গেলেন অখ্যাত রেল স্টেশনে- তখনও তিনি বোধের তাড়নায় চৈতন্যের হাহাকারে ভেসেছেন। পীড়ণ তাকে পঁই পঁই করে বুঝিয়ে দিয়েছেন জীবন কী? শিল্প কী? যাপন কতটুকু আইন ও ঔচিত্যের সীমা টানবে? 
.
ইমাম শামিলের জীবন তাকে ককেসাসের মুক্তির সংগ্রাম লিখতে কীভাবে তাড়িত করেছিল তার উপন্যাসের চরিত্রগুলোর ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ না করলে বুঝা যায় না! যারা ‘মানুষ কেন গান গায়’ এ বোধের পেছনে শুধু রাজনীতি বুঝেন তারা আর যাই হোক জীবনের অতল গহ্বরে প্রবেশ করতে পারেন না! পারেন শুধু এক চোখা তাত্ত্বিক হয়ে ইতিহাসের দ্বান্দ্বিক বিশ্লেষণে। ‘হাজী মুরাদ’, ‘ককেসাসের বন্দী’, ‘কসাক’ পড়লেই বুঝা যায় জীবনের পরতে পরতে কত রণ ও মুক্তি আকাক্সা লুকিয়ে আছে।  
.
ফাদার সিয়ের্গি’ যারা পড়েছেন তারা তো জীবনের সাথে সামাজিক বোধ ও চৈতন্যের খেলো অবস্থান টের পেয়েছেন। দ্বন্দ্বের মাঝে পড়েই মানুষ জীবনের মাহুর্তিক জ্যোতিরময়তা ও উপলব্ধির বহুমুখিতা টের পান। আমাদের সামাজিক জীবনের কত বড় অভিনেতা হয়ে আমরা স্ববিরোধী অভিনয় করে যাচ্ছি! কিংবা আমাদের ভেতরগত মনন বাস্তবতায় কত হাজার খাদ আমরা পেতে রেখেছি- আধুনিক সাইকিয়াটিস্টদের গবেষণার সহায়ক হবে এর গল্পগুলো। 
.
যুদ্ধ ও শান্তি’র হাজার চরিত্র কিংবা ‘রিজারেকশন’র ঘটনাপুঞ্জ বিস্ময় সৃষ্টি করে একজন লেখকের মনোচৈতন্যের বিশালতা ও বৈচিত্র্যের, উপলব্ধির বর্ণিলতা ও সাগরিকতার, চৈতন্যের বিমুগ্ধতাকে কতটুকু মমতায় ছেঁনে তুলেছেন তার লিপি অরে। কিংবা যদি ধরি ‘আন্না কারেনিনা’র কথা। পাঠক ভাবতে পারে ইতিহাস, বোধ, জাতিত্ববোধ, মনোগঠনের বর্ণিল বিভা, প্রেম কতটুকু হলে আজও পাঠ্য হয়ে দাঁড়ায় এ জটিল-জলো-রাহস্যিক সময়ে! ‘শিল্প’ প্রসঙ্গ টানতে ‘তলস্তয়’ চলে এলো এ জন্য যে, শিল্প নিয়ে এই মহামুনি যেভাবে ভেবেছেন অন্যরা সেভাবে জীবনে ও যাপনে তা করেননি। এমন কি তা নিয়ে যে দু’টো মহামূল্য ভাষ্য লিখে গেছেন, অনন্য হয়ে আছে তা ভাবনার জন্য, বিশ্লেষণের জন্য, বিশ্লেষণ পদ্ধতির বিশিষ্টতা ও উপলব্ধির জায়গায় ভিন্নতার জন্য। 
.
শিল্প নিয়ে কথা আছে ‘কোন এক শতাব্দীতে দু’জন মনীষীকে পাওয়া যাবে না ঐক্যমত’ হয়েছেন। সে পুরোনো কথা। আসল কথা হচ্ছে তলস্তয়ের মত ভাবনা তেমন কেউ করেননি। শুধু ভাবনা নয় গল্প ও উপন্যাসের উপস্থাপনায় কিংবা কাহিনীর জাল বিন্যাসে তিনি এমনভাবে সাজিয়েছেন একজন পাঠকের মনেই হয় না তিনি গল্প কিংবা নভেল পড়ছেন। আশলে পড়ছেন নয় দেখছেন। দেখছেন নয় তার চোখের সামনে চিরপরিচিত চরিত্রগুলো যেন একে একে ঘটিয়ে যাচ্ছেন ঘটনাগুলো। কারণ তার গল্প শুধুই গল্প ছিল না, ছিল উপলব্দি জীবনের কথকতা। অনুভূতিপ্রবণতা তাকে এত আচ্ছন্ন রাখতো যে বাস্তব জীবনে নাগরিক দুঃখ দেখেই তিনি বিচলিত হয়ে উঠতেন। ‘তাই সব ছেড়ে ছুড়ে চলে গিয়েছিলেন আবার একান্ত নিবাসে।’ তাই তার গল্প পাঠ জীবন পাঠের মতই। তার জীবন পাঠ বিশেষ করে Childhood, Boyhood and Youth গল্পগুলো পড়লেই হয়ে যায় তার জীবনকে দেখা আর তার সাথে মিলিয়ে যদি গল্প উপন্যাসগুলো দেখা হয় তাহলে আমাদের কাছে এমন এক জীবন উঠে আসে যা অনুভবে অনুরণনে আপ্লুত, অনুভূতির স্নিগ্ধতায় উদ্বেলিত, চৈতন্যের সততায় অনুশোচনা য়, পাপ-পূণ্যের দ্বন্দ্বে চির আধুনিক এক মানুষের উপলব্ধি। যা মানুষকে ভাবায়, কাঁদায় আবার চৈতন্যে আলো জ্বালিয়ে দেয়। 
.
তার বর্ণাঢ্য সাহিত্যে উঠে এসেছে রাশিয়ার সামাজিক জীবন, তাদের মনোচৈতন্য ও উপলব্ধির এক হীরকময় বহুমাত্রিকতা- তা পুরো রাশিয়ার সমস্ত সাহিত্যচর্চায় আর হয়েছে কিনা সন্দেহ আছে। তাই ম্যাক্সিম গোর্কি বলেছিলেন, তার রচনা থেকে আমরা রাশিয়ান সমাজ জীবনের যে বিস্তৃত বিবরণ পাই, অবশিষ্ট সমগ্র রুশ সাহিত্য থেকে তার অর্ধেকও খুঁজে পাই না।’
.
প্রায় ৪ হাজার একর জমির মালিক হয়েও তিনি জারদের যাপনিক সংস্কৃতিতে বিশ্বাসী ছিলেন না। তাই রুশ বিপ্লবের নায়ক লেনিনকে স্বাগত জানাতে পেরেছিলেন, বিপ্লবকেও পুশেছিলেন হৃদয়ে। আর কর্ম ও তৎপরতায় তিনি তাদের মাঝে কাউন্ট নয় ঋষি হয়ে উঠেছিলেন। তার জীবনের উপান্তে এসে যখন সমস্ত জমিদারি, সমাজ সংসার ছেড়ে দিয়ে অখ্যাত রেল স্টেশনে ঢেড়া গেড়েছিলেন তখন তার গাউনের ভেতরে ছিলো উপমহাদেশের অনন্য শিল্পতাত্ত্বিক শাহেদ সরওয়ার্দী সংকলিত প্রফেটের হাদীস সংকলন। মহত্ব ছূঁয়েছিল মহৎ হৃদয়, মহত্তম শিল্পীর জীবন হয়ে ওঠে অনুভূতির তরঙ্গে ভাসমান ঊর্মীমুখর। 
.
লেভ তলস্তয় নিজেই বলেছিলেন, ‘শিল্প কী’ এ প্রশ্নটি তাকে ভাবিয়েছেআলোড়িত করেছে প্রায় পনেরটি বছর। তার সেই আলোড়নের অনুভূতিমালা তার শিল্প বিষয়ক প্রবন্ধগুলো। যা দু’টি পৃথক গ্রন্থাকারে রূপ পেয়েছিল। একটি তার বিখ্যাত On Art অন্যটি শিল্পতত্ত্বের আকড় গ্রন্থ What is Art। ১৮৯৮ সালে প্রকাশিত What is Art গ্রন্থটি লেভ তলস্তয়ের শিল্প চিন্তার পূর্ণ অবয়ব। বলা যায় এটি শিল্প বিষয়ক একটি অভিসন্দর্ভ। যার লেখক, তত্ত্বাবধায়ক, নির্দেশক একজনই। যিনি সর্বকালের জীবন ঘষে উপলব্ধি করা এক শিল্প তাত্ত্বিকÑ কাউন্ট লিও নিকলায়েভিচ্ তলস্তয় (১৮২৮-১৯১০), যিনি নোবেল পাননি, অথচ নোবেল পাওয়ার জন্য কি কি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত হতে হয় একজন সাহিত্যিকের জীবন ও সাহিত্য তা দেখিয়ে গেছেন বিশ্ববিবেককে। 
.
প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য শিল্প চিন্তার এক সূক্ষ্ম পার্থক্য রয়েছে। প্রাচ্য জীবনের সমস্ত বিষয় প্রসঙ্গকে রসগত প্রেক্ষিত দেখে, বিশ্লেষণ করে। পাশ্চাত্য জীবনকে দেখে বস্তুতান্ত্রিক অবয়বে। আমরা রুহ দেখলে ওরা দেখে শরীর। তাই আমাদের ও তাদের সমস্ত চৈতন্যিক ভাবনায় এক ধরণের প্রান্তিকতা কাজ করে। জীবনকে যুথবদ্ধভাবে দেখার কোনো দৃষ্টিভঙ্গি তাই আমরা দাঁড় করাতে পারিনি। দৃষ্টির এ একরৈখিক চেতনা আমাদের কাছে সীমাবদ্ধ, খণ্ডিত এবং প্রান্তিক। শিল্প ও জীবন বিশ্লেষণে একমাত্র ‘লেভ তলস্তয়’কে পাওয়া যায় জীবনের সমগ্রতাকে ছুঁয়ে দেখার সাহস। শরীর ও চৈতন্যের সমস্ত অবয়ব কেঁটে খুঁড়ে বের করে শিল্পকে ছেঁকে নেয়া শুধু তলস্তয় করেছেন। তার ভাবনায় কাজ করেছে ঔচিত্যবোধ, জীবন বাস্তবতা ও স্বাভাবিকতা।  
.
পাশ্চাত্যের শিল্পতাত্ত্বিক অ্যারিস্টটল ও ক্রোচের ভাবনার সাথে যারা পরিচিত তারা আমার বিশ্লেষণের সাথে বিষয়টা মিলিয়ে নিতে পারেন। এবং শাহেদ সরওয়ার্দীর অল্প বিস্তর শিল্প ভাবনা ও অবনীন্দ্রনাথের শিল্পভাবনাকে যদি একটু চেখে নেন তাহলে পুরো মূল্যায়ন পষ্ট হয়ে উঠবে। 
.
লেভ তলস্তয় তার What is Art সন্দর্ভে যে দিকগুলোতে আলো ফেলেছেন তা হলো, শিল্প বিষয়ে শ্রম, সময়, নৈতিকতা, মতা, বিকৃতি, বোধগম্যতা, উপাদান, পরিকল্পনা, বিজ্ঞান ইত্যাদি বিষয়ের দিক থেকে ছেঁকে ছেঁকে বিশ্লেষণ। যাকে বলা হয় চারদিক থেকে আলো ফেলা। আলো ফেলে ফেলে চিন্তন রাজ্যে পষ্ট করেছিলেন আসলে শিল্প কী? সাথে এ পর্যন্ত শিল্প বিষয়ে যে রূপতাত্ত্বিক ও অবয়ব বা কাঠামোগত যে ধারণা কিংবা সৌন্দর্যগত ও প্রয়োজনগত যে মাত্রাকে অন্যান্য শিল্পতাত্ত্বিকরা ব্যাবচ্ছেদ করেছেন তা পুন: তুল্যমূল্যের মানদণ্ডে ব্যাবচ্ছেদ করেছেন তিনি। তলস্তয় চিন্তাকে উসকে দিয়ে উপলব্ধির দোর গোড়ায় ঠেলে দিয়েছেন পাঠককে। একক ভাবে সিদ্ধান্ত দেননি ‘শিল্প কী’। কিন্তু পাঠক পড়তে পড়তে বুঝে যায় লেভ তলস্তয় শিল্প বলতে বুঝিয়েছেন অনুভূতির সঞ্চালন, সম্মোহন বা স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় পাঠগত আচমন। লেখক-পাঠক-ঘটনা তখন এক বিন্দুতে দাঁড়িয়ে সর্বকালের অনুভূতি সঞ্চালনে হয়ে ওঠে এক জাতিস্মর প্রতিবিম্ব।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন