পৃষ্ঠাসমূহ

সম্পাদকীয় ১ম বর্ষ, ১ম সংখ্যা, জুন ২০০৯



আমরা জানি যে, আমরা জানি না...  
প্রদর্শ কলা, শিল্পের দায়, আমাদের ব্রত
.
আমাদের প্রচেষ্টা যখন আমরা শুরু করেছি, ততক্ষণে বাংলাদেশের নাটকের ‘স্তর বিবর্তন’ ঘটেছে বেশ। সঙ্গীতের ধারা বিবর্তন হয়েছে। একই কথা চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও সত্য। এই বিবর্তন যতটা আঙ্গিক, ততটাই ভাবগত। পাশ্চাত্যের নন্দনে ও অলংকারে সজ্জিত হয়েছে আমাদের শিল্প নানাভাবে কিন্তু প্রাচ্যের প্রজ্ঞা থেকে দিনে দিনে ঠিক ততটাই যেন দূরে সরে দাঁড়িয়েছে। শিল্পের আবার প্রজ্ঞা কি? শিল্প মাত্রেরই প্রজ্ঞার সম্পর্ক থাকে। প্রদর্শ-কলা, যা শিল্পের বাহ্যিক প্রকাশ, শিল্পের প্রজ্ঞা সেই প্রকাশে যতটা সম্ভব মূর্ত হয়ে ধরা দেয়। প্রজ্ঞাহীন যে শিল্প, তার প্রকাশে, শিল্প হয় বিকৃত এবং বিক্রিত। তাহলে শিল্পের দায় কোথায় গেলো? সার্বজনীনতার নামে নির্দায় কিংবা নির্মেরু শিল্প সাময়িক ভোগের প্রয়োজন পূরণ করতে পারে কিন্তু তার সত্যিকার সার্বজনীন উপভোগ্যতা কই? আমাদের বিবেচনায় প্রদর্শ-শিল্প নির্দায় হতে পারে না। বহুদিনের বিনা ব্যবহারে ঐতিহাসিক তাত্ত্বিক যে ফাঁক এখানে সৃষ্টি হয়েছে, আমরা তা অনুভব করতে পারছি। তার অনুসন্ধানই আমাদের ব্রত। আমরা দেখেছি, সমাজের মননশীল মানুষের এক বৃহৎ অংশ অনেকতর রূপে শিল্পের ‘প্রদর্শকলা’ (Performing art)-এর যুক্তিতে নিবিষ্ট। আমাদের বিশ্বাস মানুষের মনোগ্রন্থির এই শৃঙ্খলটিকে অবজ্ঞা না করে তার কল্যাণ উপযোগ প্রশ্রয় ও পরিচর্যায় ও সভ্যতার কাম্য পরিবর্তনে ভূমিকা রাখা সম্ভব।  
.
শিল্পের জন্য শিল্পের রিফরমেশন  
.
আমরা স্বপ্ন দেখি, ঐতিহ্যকে পুনরুদ্ধারের। সেখানে নির্মাণ, বিনির্মাণ, সংগঠন, সংস্করণ, সন্ধানের মিশেলে সম্ভব হবে সভ্যতার কাম্য পরিবর্তন। আড় ভাষায় কেউ ব্যাখ্যা খুঁজতে চেষ্টা করতে পারেন। পড়ে-পড়ে, তথ্যে-তত্ত্বে দার্শনিক হয়ে উঠা ক’একজন পুঁছ করতে পারেন, “আপনাদের রিফরমেশনটা কি? তার আগে ফর্মটা কি?” আমরা নড়েচড়ে বসি। আমাদের শিল্পকে প্লেটো, ফুয়েরবাখ, র্মাক্স আর হেগেলের দর্শন দিয়ে ধর্ষণ চেষ্টায় কিছুটা বিড়ম্বিত হই। সারাদিন ঝিমিয়ে ঝিমিয়ে তথ্যসমৃদ্ধ তত্ত্ব কপচানোর পর যারা অ্যারাবিয়ান বা ইউরোপিয়ান কান্ট্রিগুলোর অনুদানের ভর্তুকির টাকার চালগুলো নিশ্চিন্তে গিলতে যান, তাদের অযোগ্য ইনফরমেটিভ থিওরীগুলোর ভেতরের অবিশুদ্ধ নিয়ত ঠাহর করি। পালকী আমাদের ঐতিহ্য, তাই রাস্তা থেকে রিক্সাগুলো তুলে দিয়ে ছয়বেহারার পালকী চালু করা উচিত কি? আমাদের ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা বলে যে, তত্ত্বে, তথ্যে আর বাস্তবে অনেক ফারাক। শিল্পের কোন প্রমিত আদর্শ রূপ থাকে না, বরং উৎকর্ষতা থাকে, প্রচলিত প্রদর্শ-শিল্প’র একটা রিফরমেশন প্রয়োজন এটা আমরা উপলব্ধি করি। এই রিফরমেশন ভাষায়, বিষয়ে, ভাবনায় এবং নিয়তে। ঐতিহ্য রক্ষার নামে মধ্যযুগে ফিরে যাওয়া এই শিল্পচর্চার উদ্দেশ্য নয়। তাহলে এই রিফরমেশনের স্বরূপটা কি? আগে থেকে তার কিছুই বলা যাবে না। তার কারণ এটা একটা প্রায়োগিক এবং ব্যবহারিক জায়গা। সমাজ, রাজনীতি, জনগণ, অর্থনীতি, রাষ্ট্রের কর্ণধার, ক্ষমতার বিবর্তন, ধর্ম এসব থেকে তা (রিফরমেশন) নিরাবেগ, নিস্পৃহ এবং নির্মোহ থাকবে না, এতটুকু বলতে পারি। তাই এই রিফরমেশন রেভুলুশন হতে পারে, ডিফরমেশন কিংবা ডিকনস্ট্রাকশন কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে।  
.
নিছক শিল্পের জন্য শিল্পচর্চা আর মাঝ নদীতে মাঝিবিহীন ময়ূরপঙ্খী নৌকা এ দুইয়ের মধ্যে খুব একটা পার্থক্য নেই। রাষ্ট্র পারিপার্শ্বিকতা শিল্প জরুরী অবস্থা, ধর-পাকড়, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল, সাজা, সাজাপ্রাপ্ত আসামীদের জামিনে বেরিয়ে আসা, বিডিআর-নাসাকার মুখোমূখী অবস্থান-সেক্টর কমান্ডারদের নিরবতা, বিদ্রোহের ছদ্মনামে সামরিক বাহিনীতে হত্যাযজ্ঞ, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়ার ধীর গতি রাষ্ট্র সংবিধান এবং ন্যায় বিচারের ঘোরতর দূর্দিনে শিল্প তার শিল্পের চর্চায় ব্যস্ত থাকে। এহেন পারিপার্শ্ব অস্পৃশ্যতা আমাদের পীড়া দেয়। কিন্তু এহেন অস্পষ্ট সময় শিল্পের আরো, আরো স্পষ্ট চেতনা দাবী করে। এ রকম ঘোর সংকটে নিছক শিল্পচর্চা আর সত্যকে পাশ কাটিয়ে যাওয়া, একই কথা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে কোন রাষ্ট্রের পক্ষে অন্য কোন স্বাধীন রাষ্ট্র দখল করে উপনিবেশ স্থাপন করা সম্ভব নয়। কিন্তু কোন স্বাধীন রাষ্ট্রের উপর রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণ আরোপ করে নয়া উপনিবেশ ঠিকই সম্ভব। আমরা এখন শঙ্কিত: নতুন কোন পলাশী দরজায় কড়া নাড়ছে না তো!  
.
রাষ্ট্র শিরোনামে দুঃখজনক হলেও সত্য, আমরা আমেরিকা, ভারত কিংবা ইউরোপের না হয়ে, হয়েছি বাংলাদেশী। এ দুঃখের উৎস বাংলাদেশী হওয়ায় নয়, বরং বাংলাদেশকে ভালোবাসায়। তাই এই প্রচেষ্টা নিঃস্বার্থ নিরাবেগ নিঃশঙ্ক এবং নিঃসাহসী নয়।  
.
প্রসঙ্গঃ লোকযাত্রা  
.
আমাদের উপরোক্ত উপলব্ধি এবং তৎসঞ্জাত সক্রিয়তা কেবল আমাদের নিজেদের জন্য নয় (নব্য একটি স¤প্রদায়, পার্টি, গোষ্ঠী হিসেবে আত্মপ্রকাশ আমাদের উদ্দেশ্য নয়), এর প্রকাশ ও বিস্তার চাই আমরা সাধারণ মানুষের মধ্যে। লোকযাত্রা আমাদের এবং পাঠকের যোগাযোগ মাধ্যম। বলাবাহুল্য, লোকযাত্রা-কর্মীবৃন্দ সকলে থিয়েটার কর্মী। তাই এতে প্রকাশিত লেখাগুলো থিয়েটারের প্রতি অনিচ্ছাকৃত পক্ষপাতদুষ্ট হতে পারে। তবে লেখক-পাঠকদের সহযোগিতা আমাদের এই দুর্বলতা কাটিয়ে উঠতে সাহায্য করবে।  
.
প্রসঙ্গত: লোকযাত্রা নামটি এবং Performing art এর বঙ্গানুবাদ ‘প্রদর্শ কলা’ করে দিয়েছেন কবি সৈয়দ আহমদ শামীম, তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞতা। নিবেদন পরিশেষে নিবেদন, আমরা কারা? যারা জানে যে, তারা জানে না আমরা তাদের নবীন সহযাত্রী।  
.
বিনীত মাসউদুর রহমান  
সাইফ শাওন


1 টি মন্তব্য: