পৃষ্ঠাসমূহ

সাম্প্রতিক নাটকের একটি সমস্যা

সাম্প্রতিক নাটকের একটি সমস্যা  
ঋত্বিককুমার ঘটক  
.
একটি নাটকের কাগজ পরিচালনা করতে গিয়ে আমি নানারকম নাটকের সম্মুখীন হয়েছি। এগুলো দেখে আমার মোটামুটি ধারণা জন্মেছে নবীনরা যা করছেন, তার অধিকাংশই গজভুক্ত কপিত্থবৎ। দেশজ ঘটনাগুলোকে এঁরা সম্পূর্ণভাবে গ্রহণ এবং অনুশীলন করতে পারেন বলে আমার মনে হয়নি।  
.
এঁদের কেউ কেউ একটা ফরাসী ব্যাপার অনুসরণ করছেন, যাকে এঁরা নাম দিয়েছেন অ্যাবসার্ড ড্রামা। ব্যাপারটা ঠিক আমি বুঝে উঠতে পারি না। ফরাসীদের একটা স্বভাব আছে, বদভ্যাসই বলতে পারেন। শিল্পীরা কাজ আরম্ভ করেই একটা ম্যানিফেস্টো বের করেন। জাঁ আনউই এই অ্যাবসার্ড ড্রামা কথাটির জন্ম দিয়েছেন। এ ব্যাপারটাই আসলে অ্যাবসার্ড। স্ট্রীন্ডবের্গের এক্সপ্রেশনিস্ট ড্রামা যাঁরা পড়েছেন, তাঁরা জানেন আনউই নতুন কিছু করেননি। বেকেট সম্পর্কেও একথা প্রযোজ্য। আজকালকার ছেলেরা স্ট্রীন্ডবের্গ বা ইবসেনের শেষদিকের কাজগুলো পড়েননি বলেই মনে হয়। এখনকার আনউই আর বেকেট এঁদেরকে নিয়ে এত নাচানাচি তা হলে হত না।  
.
আসলে ঘটনাটা হচ্ছে, আমাদের অধিকাংশ সা¤প্রতিক নাটকে মানব জীবন থেকে দূরে সরে যাওয়ার একটা ব্যাপার ঘটছে। প্রতিটি শিল্পীর কাছে মানুষের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে যাবার একটা প্রশ্ন আছে। সেই জায়গা থেকে বিচ্যুত হলে পরে নানা কিসিমের উদ্ভট জিনিসের ব্যবস্থা করতে হয়, যাতে করে সস্তায় কিস্তিমাত করা যায়। আমাদের তরুণদের অনেকে তাই করছেন। বাংলাদেশে এখন দুটো দিকের ব্যাপার ঘটছে। একদিকে আমাদের গ্রামীন জীবনযাত্রা প্রচণ্ডভাবে বদলানের জন্য সি. আই. এ.-এর টাকা; আর-এক দিকে কিছু সৎ মানুষ সৎ উদ্দেশ্য নিয়ে কিছু চেষ্টাচরিত্তির করছেন কিন্তু তাঁদের ক্ষমতা নেই। সত্যিই ঘটনাটা গুলিয়ে গেছে। নজরুলের ভাষায় বলতে হয়, “দে গরুর গা ধুইয়ে।” ব্যাপারটা হয়েছে তাই। কিন্তু কথা হচ্ছে, দেশ এগোচ্ছে। নতুন শিশুদের জন্ম হচ্ছে এবং তারা নতুন জগৎ দেখছে। তাদের সম্বন্ধে তাদের বোধগম্য ভাষায় কথা বলতে হবে। আজকের বাংলাদেশের যে দুঃখ-দুর্দশা আমরা মাঠে ঘাটে দেখি, সেটি কলকাতা শহরে বসে অনুভব করা সম্ভব নয়। তাকে ভাষা দেওয়ার একটা প্রশ্ন আছে। সেই ভাষা ফুটিয়ে তোলার পক্ষে মঞ্চ হচ্ছে সবচেয়ে সহজ রাস্তা। সেখানে নিছক অনুবাদ আর অনুকরণ আর অনুসরণ দিয়ে নিছক মানুষের মন ভোলানো চোখ ধাঁধাঁনো পাপ বিশেষ। আজকের তরুণ নাট্যকাররা এই কথাটি যেন দয়া করে মনে রাখেন। আমার দেশ প্রচণ্ড দেশ। এদেশের মানুষের তুলনা নেই। এদের দেখলে প্রাণের মধ্য থেকে আমার ভালোবাসা উথলে ওঠে। সাধারণ গ্রামীণ মানুষ, তাদেরকে যখন আমি খাটতে দেখি আমার মন তখন ভালোবাসায় উদবেল হয়ে ওঠে।  
.
এঁদের জীবনযাত্রাকে প্রকট করার কি কোনো রাস্তাই পাওয়া যাবে না? তাহলে আমরা কীসের শিল্পী? শিল্পী বলে গৌরব করার আমাদের কী আছে? আমরা কী করেছি? কিছু করতে পারিনি। নাটক একটা অত্যন্ত শক্তিশালী মাধ্যম। তার মধ্য দিয়ে আমরা অনেক কথা বলতে পারতাম। পারিনি।  
.
আমি নিজে স্বীকার করছি যে আমার যেটুকু করণীয় ছিল তা আমি করে উঠিনি। অনেক হারিয়েছে। কিন্তু তরুণরা, যাঁরা দাবী করেন নাটকের ব্যাপারে খুব কিছু একটা করছেন তাঁরা কি একবারও গোটা ব্যাপারটাকে ভেবে দেখবেন না? দেশের মানুষকে ছেড়ে তাঁরা কেন এইসব আজেবাজে টেকনিকের মধ্যে ঢুকলেন (টেকনিক সম্পর্কে অবশ্য এঁদের অনেকেই কিছু বোঝেন না)। কেন এঁদের অনেকেই শুধু মন ভোলানো চোখ ধাঁধাঁনো নাটক করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন? এই তরুনদের মধ্যে সত্যিই কি মেরুদণ্ডশালী কেউ নেই যিনি সত্যিকারের কাজের কাজ করতে পারেন? দেখুন, সব শিল্পই শেষে গিয়ে পৌঁছয় কবিতাতে। এবং সে কবিতা হয় মেহনতি মানুষের দুঃখ-দুর্দশার ঘামে ভেজা কবিতা। এ ছাড়া কোনো শিল্পের শেষ অবধি টেঁকার কোনো ব্যাপার থাকে না, কোনোদিন থাকেনি। বলতে দুঃখ হচ্ছে যে এই পোড়া বাংলা দেশে এইসব বহু পুরাতন কথা আজ আমাকেই আবার বলতে হচ্ছে। কিন্তু কথাটা হচ্ছে, এই কথাগুলো আজ আবার বেশ চেঁচিয়ে বলা দরকার।  
.
রবীন্দ্রনাথের ভাষায়, “মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানো পাপ।” আমিও মানুষকে অবিশ্বাস করার মতো অবস্থায় পৌঁছইনি। আমি জানি এই শিশু, এই ছেলেপুলে, এই তরুণদের মধ্য থেকেই আবার মানুষ উঠবে এবং বাংলা দেশকে তারাই আবার তুলে ধরবে। এদের ওপরই ভরসা। এরাই নাটককে কোন নতুন দিকে মোড় ফেরাবে। এরাই সেই ব্যাপারটা করে ফেলবে, যেটা আমরা এখনো ধরতেও পারছি না। এদের ভরসাতেই আশা করা যায়। ১৯৫১ সালে সাংবাদিক হিসেবে কলকাতা শহরে এক মাসে মোট ৩৬টি আত্মহত্যার ঘটনা আমাকে রিপোর্ট করতে হয়েছিল। কিন্তু ব্যাপারটা নিয়ে নাটক না লেখা পর্যন্ত আমার নিজের জ্বালা মিটল না। ব্যাপারটা কি? মৃত্যুর পর ৬টি চরিত্র একটা কাল্পনিক জায়গায় মিলিত হয়েছে। তারা কথাবার্তা বলে বুঝল সংসারে ছেলেপিলেরা তো আছে। ও আত্মহত্যা-ফত্যা কোনো কাজের কথা নয়, কোনো পথ নয়। তখন পৃথিবীতে তারা খবর পাঠাল যে, ‘সবাই বাঁয়ে হঠো।’  
.
ঋত্বিক কুমার ঘটক, চলচ্চিত্রকার হিসেবে যাঁর পরিচিতি, অবস্থান অতি উচ্চে। কিন্তু ভারতীয় গণ-নাট্য আন্দোলনের তিনি ছিলেন প্রধান ব্যক্তিত্ব। এই আন্দোলনের মূলনীতির খসড়াও তিনি তৈরী করেন। সমকালীন তরুণ প্রজন্মের নাট্যচেতনা নিয়ে লেখা তাঁর এই প্রবন্ধটি আজও সমকালীনতা হারায়নি। তাই তা পুনর্মুদ্রণ করা হলো।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন