পৃষ্ঠাসমূহ

বাংলাদেশের নাটক : ক্ষুদ্রের পর্যবেক্ষণ

বাংলাদেশের নাটক : ক্ষুদ্রের পর্যবেক্ষণ  
রাফসান গালিব .
সত্যকে প্রতিনিধিত্ব করার একটি বিশেষ ক্ষমতা নাটকের আছে। আর তাই সত্যকে আঁকড়ে ধরেই সমাজের প্রতি সৃষ্টি হয়েছে তার বিশেষ দায়বদ্ধতা। তাই নাটকে সেই আদিকাল থেকে কোন না কোনভাবে সমাজের কথা গণমানুষের কথা উঠে আসে। কখনো সখনো উঠে আসে সমাজের শ্রেণীবৈষম্যের কথা। কোথাও গৌণভাবে, কোথাও মূখ্যভাবে। বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে যেমন- রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, জমিদার-কৃষক, মালিক-শ্রমিক, প্রভু-দাস এমনকি নারী-পুরুষ ইত্যাদি প্রসঙ্গ চলে আসে খুব অনায়াসেই। তাই গণমানুষের কথা, তাদের ন্যায্য পাওনার কথা, তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা, অন্যায়-অত্যাচার, সেই সাথে প্রতিরোধের কথাও ঘুরে ফিরে ধরা দেয় পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে। আমরা যদি উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতি উপজাতি ও তাদের রাজনৈতিক সাংস্কৃতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করি তাহলে দেখা যায়, ব্রিটিশের দুঃশাসন, নবাবী প্রতিরোধ, সিপাহী আন্দোলন, ফরায়েজী ও ফকীর আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন তারপরে দেশভাগ এসব পরিস্থিতিই আমাদের ইতিহাসের জীবন্ত কিছু মূহুর্ত। যদিও এসব ঘটনার পেছনে অনুঘটক হিসেবে কাজ করেছিল ভৌগলিক, রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কারণসমূহ। কিন্তু মূলভিত্তি ছিল অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং কিছুটা জাতীয়তা ও 
সা¤প্রদায়িকতাবোধ। যা আরো পরে গণমানুষের প্রাণের আন্দোলন- স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। .
বাংলাদেশে স্বল্প পরিসরে গড়ে উঠা নাট্য আন্দোলনের ইতিহাসও গণমানুষের এই ঘটনাবহুল ইতিহাসের প্রভাব সম্পূর্ণরূপে এড়িয়ে যেতে পারেনি। কারণ ইতিহাসের ঘটনা পরম্পরায় নাটকের আঙ্গিক এবং বিষয়বস্তুর পরিবর্তন লক্ষণীয়। ব্রিটিশ ভারতে কলকাতাকেন্দ্রিক হেরেশিম লেবেদেফ প্রবর্তিত নাটক আর ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ের নাটকের বিষয়বস্তুতে ফারাক বিস্তর। কারণ আমরা দেখি যে, এ সময় ইংরেজ সরকার কর্তৃক নাটক নিয়ন্ত্রন আইন নামক কালা কানুনটি তৈরী হয়। .
কিন্তু সমকালীন নাট্যচর্চা আমাদের কি দেখাচ্ছে? মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তী সময়, বিশেষ করে ৮০/৯০-এর দশকে রাজনৈতিক আন্দোলনের পট পরিবর্তিত হওয়ার সাথে সাথে পরিবর্তন আসে দেশের নাট্য আন্দোলনের মেজাজেও। রাজনৈতিক চিন্তাধারার বিভক্তির সাথে সাথে নাট্য আন্দোলনের মুক্তচিন্তায়ও পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় এ সময়। যার কারণে মঞ্চে ম্রিয়মান হয়ে পড়ে আমাদের জাতীয় পরিচয়ের শেকড় সন্ধানের বা শেকড় আঁকড়ে ধরার চেষ্টা। ম্রিয়মান হয়ে পড়ে সমাজ পরিবর্তনের আশা আকাঙ্খা। মূলতঃ এ সময় থেকে আমাদের নাট্যমঞ্চগুলো অনেকটা দখল হয়ে যায় বিদেশী সাহিত্যের অনুবাদ নাটক দ্বারা, যাদের ঐতিহ্য সংস্কৃতির সাথে এদেশের মানুষ খুব একটা পরিচিত নয় (সেলিম আল দীন, মমতাজউদ্দিন আহমদকে এ হিসেবের বাইরে রাখতে হবে)। তাছাড়া অধিকাংশ নাটকের অনুবাদ, ভাবানুবাদের জটিলতার কারণে দর্শকরা নাটকের বিষয়বস্তু বুঝতে গিয়ে হিমশিম খেয়ে যায়। এতে কিন্তু নাটক গণ-সম্পৃক্ততা হারিয়ে ফেলছে। চিন্তা করুন, ঢাকার জনসংখ্যা এক কোটি ছাড়িয়ে গেছে অনেক আগেই, সে হিসেবে পাঁচ হাজার নিয়মিত দর্শক পাওয়া যাবে না, গ্র“পগুলোতে প্রচুর সেলিব্রেটি/তারকা সদস্যের উপস্থিতি সত্ত্বেও। ঢাকার বাইরের কথা আপাতত হিসেবের মধ্যে না আনলাম। কিন্তু পরিসংখ্যান যদি এরূপ হয় তাহলে নাট্য আন্দোলনও বা এগিয়ে যাবে কিভাবে? আপামর জনসাধারণের ধ্যান-ধারণা বাদ দিয়ে কোন আন্দোলন এগিয়ে যেতে পারে না। তাছাড়া আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, নাট্য ‘আন্দোলন’ও কিন্তু এক ধরণের রাজনৈতিক আন্দোলন। .
নব্বই দশকের শেষ এবং শূন্য দশকের শুরুর সময়টায় বাংলাদেশের মিডিয়াতে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন সাধিত হয়। কিছু বহুজাতিক কোম্পানীর আগমন এবং তাদের পৃষ্ঠ-পোষকতায় জাতির কৃষ্টি-কালচারের ধারক বাহক হয়ে ওঠে এই সব মিডিয়া। মঞ্চকর্মীরা অধিকতর ঝুঁকে পড়ে সেদিকে, সেই সাথে দর্শকরাও। যার কারণে এক সময় যে সকল সংস্কৃতি ও নাট্যবোদ্ধারা দেশের গণমানুষের চিন্তায় বিভোর থাকতেন, তারা মঞ্চকে পেছনে ফেলে মিডিয়ার দিকে ছুটেছে এবং গণমানুষের চিন্তাবহনকারীরা পরিণত হয়েছে উচ্চবিত্ত শ্রেণীতে। দুঃখজনক এবং হতাশাব্যাঞ্জক হলো, একই কথা অন্যান্য শিল্পের বেলায়ও প্রযোজ্য। এর প্রভাব আমাদের নাট্যান্দোলনেও পড়েছে ব্যাপকভাবে। সমাজের নিম্ন এবং মধ্যবিত্তদের কথা, তাদের সুবিধা-অসুবিধা কিংবা দাবীর কথা, সরাসরি এখন আর আসে না আমাদের নাট্যমঞ্চগুলোতে। বরং নাটক হয়ে পড়েছে সমাজের বিত্তশালীদের এন্টারটেইনমেন্টের বিষয়। .
এই যদি হয় সমকালীন নাট্যচর্চা, তাহলে যে কারণে এখনো নাট্য ‘আন্দোলনের’ কথা বলা হয়ে থাকে, বিভিন্ন উৎসব অনুষ্ঠানে অন্ধকারের বিরুদ্ধে আলোর জয়গান গেয়ে যে সব শ্লোগান আমরা পাই, তা কিসের জন্য বা কোন বিশেষ লক্ষ্যে পৌঁছানোর জন্য?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন