পৃষ্ঠাসমূহ

শিল্পের চৈতন্যে ‘আমি’ কৈ

শিল্পের চৈতন্যে ‘আমি’ কৈ
মাসউদুর রহমান 
.
আদমী সে চেনে আদম  
পশু কি তার জানে মরম 
লালন কয় আদ্য ধরম 
আদম চিনলে হয়।  
আপন ছুরাতে আদম গঠলেন দয়াময়...  
-ফকীর লালন সাঁই 
.
ব্যক্তির জন্য কোনটি গুরুত্বপূর্ণ, শিল্পচর্চা না শিল্পচেতনা? স্থান-কালের নিরিখে বাস্তবতা এই শিল্পচর্চা সবার দ্বারা হয়ে উঠে না। কিন্তু মানুষ চাইলেই তার ভেতরে শিল্পের চেতনাকে লালন করতে পারে, যা তাকে সবার মাঝে অনন্যরূপে পরিচালিত করতে পারে। এই শিল্পচেতনা তাহলে কিভাবে সম্ভব?
.
চারপাশের প্রকৃতিকে দেখার, অন্যভাবে, তার দিকে তাকাবার একটা সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি সৃষ্টিকর্তা দেখিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, হও, হয়ে যায়। আসলে কি তিনি বলেন? তাঁর তো বলার প্রয়োজন হয় না। তাহলে বোধহয় তিনি ভাবেন। কিন্তু তাঁর তো ভাবারও প্রয়োজন হয় না। বলা, ভাবা এসব তো মানবিক কাজ। তাহলে তিনি কী করেন? মন বলে, তিনি শিল্প করেন। তাঁর শিল্প করাটাই আমাদের বলা-ভাবা-দেখার মতো। তবে এই বলা-ভাবা-দেখা যেন তেন নয়, বিশেষভাবে বলা-ভাবা-দেখা। এরই মধ্যে রয়েছে প্রকৃতিকে দেখবার সার্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গী। কিন্তু বিশেষ কোন কিছুকে কেন সার্বজনীন বলি?  
.
সার্বজনীনতার বাইরে প্রকৃতিকে দেখবার আরেকটি দৃষ্টিভঙ্গি আছে- ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখা। এই দৃষ্টিভঙ্গি স্থান-কাল-ঘটনা-প্রেক্ষিতের প্রভাবদুষ্ট হয়। তখন যা দেখে, ‘আমি’ তার নিজের জন্য, নিজের প্রয়োজনে দেখে। প্রকৃতিকে উপযোগ মনে হয়, মনে হয় উৎপাদনের আধার। প্রকৃতি তখন শুধু ব্যক্তির প্রয়োজন পূরণ করার জন্য। ব্যক্তির যেভাবে প্রয়োজন প্রকৃতি সেভাবেই তার চোখে ধরা দেয় অথবা তাকে ধরা দিতে হয়। এই দৃষ্টিভঙ্গি প্রকৃতিকে বিকৃতি এবং ধ্বংসের ঢালু রাস্তায় নামিয়ে দেয়। প্রকৃতি আর প্রকৃতি থাকে না ব্যক্তির ইচ্ছার কাছে বিলীন হয়। .
সাধারণত সবাই প্রকৃতিকে এভাবেই দেখে বা দেখতে চায়। যেহেতু ব্যক্তিসত্ত্বা পরষ্পর স্বতন্ত্র সেহেতু এই দৃষ্টিভঙ্গিতেও কোন সার্বজনীনতা নেই - যে যার মতো প্রকৃতিকে ছিঁড়ে-কুঁড়ে খায়। তাই এই দেখার ধরণ আপাত এক মনে হলেও ল্য এবং ফলাফলে সম্পূর্ণ ভিন্ন। 
.
প্রকৃতিকে দেখার যে ভিন্ন আরেকটি দৃষ্টি সেটা হলো নৈর্র্ব্যক্তিক দৃষ্টিতে দেখা। সৃষ্টিকর্তার দৃষ্টিতে দেখা। একটা শূন্য স্থান আসলে কেমন থাকা উচিৎ এরকম দৃষ্টিভঙ্গির বেলায়, যিনি দেখবেন, তার দেখায় তার কোন ব্যক্তিগত প্রয়োজন কাজ করবে না। ব্যাপারটাকে একটা উদাহরণ দিয়ে দেখানো যায়- এক পৃষ্ঠা সাদা কাগজ, একজন ছাত্র তাতে গরু নিয়ে একখানি রচনা লিখবে আর একজন কবি সেখানে স্বদেশ নিয়ে একটা কবিতা লিখবেন। ঐ সাদা কাগজটা হলো প্রকৃতি। সৃষ্টিকর্তার প্রকৃতির কাছে কোন প্রয়োজন নেই, তাই তিনি তাকে (প্রকৃতিকে) যেভাবে খুশি দৃষ্টি দিয়ে সাজাবেন। এটাই হলো নৈর্ব্যক্তিক দৃষ্টি অর্থাৎ প্রকৃতিকে প্রকৃতির দৃষ্টিতে দেখা। কিসে প্রকৃতির ভাল তাতে ব্যক্তির নজর থাকবে। অন্যভাবে, এটাই শিল্পের দৃষ্টি বা শিল্পচেতনা। যেহেতু তা নৈর্ব্যক্তিক তাই তার প্রভাবিত বা মেরুকৃত হওয়ার সুযোগ থাকে না। প্রকৃতি এখানে উপযোগ হিসেবে উপস্থিত না, বরং কৃষিকাজের উপযুক্ত উর্বর একটি শূন্য ক্ষেত্রে, সৃজনশীলতার বিচিত্র আধার। ব্যক্তির দৃষ্টি তখন কেবল প্রকৃতির প্রয়োজন পূরণ করে, প্রকৃতির সৌন্দর্য্য খুঁজে বেড়ায়, নূতন নূতন সৌন্দর্য্য আবিষ্কার করে। সে যেখানেই দৃষ্টিপাত করে সেখানে শুধুই সৃষ্টি হয়, যেমন- সৃষ্টিকর্তা বলেন, হও, হয়ে যায়। এই দৃষ্টি শুধু প্রকৃতিকেই না, সাথে ব্যক্তিকেও সুকৃতি এবং সৃষ্টির বৈচিত্রময়তার চূড়ায় তুলে নেয়। ব্যক্তি-প্রকৃতি পরস্পরে বিলীন হয়ে নূতন এক রাস্তা ধরে। এ জন্যই এ দৃষ্টি ‘বিশেষ’ হয়। এই বিশেষ দৃষ্টি সার্বজনীন কেননা ব্যক্তি চাইলেই তার ভেতরে এই দৃষ্টিচেতনার বিকাশ ঘটাতে পারে। দৃষ্টির এই চেতনার বিকাশকেই শিল্পচেতনার বিকাশ বলতে পারি। শিল্প যদি সার্বজনীন হয়, ব্যক্তি বিশেষে জাত সকল চেতনা পূঞ্জীভূত হয়ে নির্বিশেষ শিল্প জন্ম দিতে সম (এখানে নির্বিশেষ মানে যা বিশেষ নয়, সার্বজনীন)। কারণ শিল্পের প্রভাবিতকরণ এবং সংক্রমণ মতা আছে। তাছাড়া চেতনা বিশেষ হলেও তাদের ল্য এবং ফলাফল অভিন্ন হতে পারে।  
.
শিল্প এমন একটি বস্তু যা একই অনুভূতির মাধ্যমে মানুষকে একত্রে সংযুক্ত করে... শিল্প-সংক্রমিত হবার মতা বঞ্চিত হলে মানুষের অবস্থা হতো আরো বেশি বর্বরের মতো। সর্বোপরি তারা পরষ্পরবিচ্ছিন্ন হয়ে একের প্রতি অপরে বৈরী ভাবাপন্ন হয়ে পড়তো। (লিও টলস্টয়, What is Art
.
কিন্তু প্রকৃতি কি? ‘আমি’ ব্যতীত সমস্তই প্রকৃতি। কারণ ‘আমি’র কাজ হলো প্রকৃতিকে সাজানো। ‘আমি’ যদি প্রকৃতি হয় বা প্রকৃতির অংশ হয় তাহলে ‘আমি’ অন্যকে বাদ দিয়ে তার আপনিকে সাজাতে ব্যস্ত হয়ে যাবে। ‘আমি’ ভাববে তার নিজেকে সাজানো তো প্রকৃতিকে সাজানোরই নামান্তর। কিন্তু প্রকৃতিকে সাজাতে গেলে তবে ‘আমি’কে সাজানোর ফুরসৎ কই। হয় এটা নয় ওটা। নবী-সুফী-সাধক-মহাপুরুষগণের মধ্যে তাই বোধ হয় নিজের প্রতি এক বিশেষ অবহেলা দেখা যেত। তা বুঝি এ কারণেই। আর সূফী-সাধুপুরুষদের কাছ থেকে তাই শিল্প সৃজন হয়ে আসতো কখনো কাব্য, চর্যাগীতিকা, দোঁহা কিংবা রুবাই হয়ে আবার কখনো সেমা’ কিংবা বাঁশির সুরে রুমীর নৃত্য হয়ে। এসব শিল্প’র উদ্ভব তো আসলে শিল্পস্রষ্টার প্রকৃতির দিকে বিশেষ দৃষ্টিতে তাকানোর ফসল। 
.
এই যদি হয় তবে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে, ‘আমি’ কার? ‘আমি’কে ধারণ করার পাত্র তো একটা লাগবে, তাই না? ‘আমি’ও আসলে প্রকৃতির অংশ তবে যার অস্তিত্ব অন্য অন্য ‘আমি’সমূহের চিন্তা রাজ্যে। এটা প্রকাশ পায় অপরের মঙ্গল চিন্তায়, অর্থাৎ প্রত্যেক ‘আমি’ ই নিজেকে ভুলে অপর ‘আমি’র চিন্তায়, কল্যাণ কামনায় অপরাপর অন্য সকল ‘আমি’কে অর্থাৎ প্রকৃতিকে অস্তিত্বশীল করে তোলে। অর্থাৎ ‘আমি’ নিজে ছাড়া অন্য সবার মাঝে অস্তিত্বশীল। ‘আমি’ যখন নিজেকে নিয়ে 
.
তাহলে শিল্প কি শেখায়? অপরের কল্যাণ কামনা করতে। শিল্পচেতনা তবে কি? অপরের কল্যাণ কামনা করার চেতনা। এর থেকে বিমূখ যে শিল্প, তা আসলে চেতনাবিহীন শিল্প। চেতনাবিহীন অঙ্গকে যেমন পাঘাতগ্রস্থ বলি তেমনি চেতনাবিহীন শিল্পকে পাঘাতগ্রস্থ শিল্প বলতে হয়।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন