পৃষ্ঠাসমূহ

প্রসঙ্গঃ শিল্পের উৎস

প্রসঙ্গঃ শিল্পের উৎস 
রাফসান গালিব 
.
অলৌকিক এর সাথে লৌকিকের সম্পর্কচর্চা থেকে শিল্পের যাত্রা শুরু। পৃথিবীর আদিম মানুষগুলোর ব্যক্তিগত ও সামাজিক আচরণ থেকেই যে শিল্পের উৎপত্তি- তা নিয়ে কোন দ্বিমত নেই। পরবর্তীতে সভ্যতার কালক্রমে চর্চা হতে থাকে শিল্পের ভাবাদর্শ, উদ্দেশ্য ও গন্তব্য। উন্মোচিত হতে থাকে এর স্বরূপ। শিল্প শুধু ব্যক্তি আবেগের অভিব্যক্তি নয় মানুষের পারস্পরিক সম্পর্ক নির্ণয় বা নির্মাণের অনুঘটকও। যে সম্পর্ক এমনই বাংলাদেশের একজন অন্নচাষা আর আফ্রিকার একজন অন্নচাষা কেউ কাউকে না দেখে একে অপরকে অনুভব করে। তারা উভয়েই তো প্রকৃতির মহৎ শিল্পকর্মে নিয়োজিত।  
.
শিল্পকর্ম শিল্পস্রষ্টার ব্যক্তিগত হতে পারে না। তার ভোক্তা হবে সমাজের সকল স্তরের মানুষ। তা না হলে শিল্প তার মাহাত্ম হারিয়ে ফেলবে। সৌন্দর্যহীন হয়ে পড়বে শিল্প। আর শিল্প নিছক বিনোদন কিংবা ব্যক্তিগত অনুভূতি নয় বলে শিল্পের মতাদর্শ, ভাবাদর্শ নিয়ে শিল্পস্রষ্টা ভাবতে বাধ্য হয়। শিল্পী তো শুধু শিল্পী নয়, সে একজন স্রষ্টাও বটে। কারণ শিল্পীর প্রধান দতা হচ্ছে সৃষ্টিশীলতা। যার সাথে আনন্দানুভূতি থাকবে, থাকবে শিল্পস্রষ্টার পারিপার্শ্বিক পরিমণ্ডলের সমূহ দাবী কিংবা আকাক্সা পূরণের সুন্দরতম প্রচেষ্টা। একটি শিল্পকর্ম সমাজের যাবতীয় ভাল, সুন্দর আর সত্যগুলোই প্রকাশ করবে, চিহ্নিত করবে যাবতীয় মন্দগুলো। তখনই শিল্পকর্মটি হবে উৎকৃষ্ট আর উঁচুমানের।  
.
শিল্পচর্চায় শিল্পীরা বিশেষ এক জগতের আশ্রয় নেয়। তাকে যদি বিমূর্ত বলা হয়, তাহলে বিমূর্তের মূর্ত প্রচেষ্টাই শিল্প। সরাসরি মূর্ত একটি শিল্পকর্ম দ্বারা ভোক্তার যে চিন্তার প্রতিফলন কিংবা সামূহিক সমাধান ঘটে তা আরো ব্যাপকতা লাভ করে বিমূর্ততায়। কারণ বিমূর্ত’র নির্দিষ্ট কোন ভাষা নেই। পৃথিবীর তাবৎ জনগোষ্ঠী যে কোন ভাষায় বিমূর্ত শিল্পের অর্থ উদ্ধার করতে পারে। সেই সাথে যোগাযোগ ঘটে সকল শিল্প ভোক্তার। 
.
বিমূর্ততা এমন এক জগৎ, যা দ্বারা শিল্পী অযাচিতভাবে তার শিল্প সৃষ্টিতে আচ্ছন্ন থাকে। এ জগতের সাথে শিল্পীর দৈহিক যোগাযোগ না ঘটলেও আত্মিক যোগাযোগ তো আছে। যোগাযোগ আছে বলেই সমূহ বিমূর্ত মূর্ত হয়ে উঠে বিমূর্ততায়। শিল্পী তার শিল্পকর্ম সৃষ্টিতে সুখানুভূতি পায় ভিন্ন এই জগতের অস্তিত্বকে লালন করে বলে। .
এই অলৌকিক জগতের সন্ধান করতে গিয়ে তো এক পর্যায়ে শিল্পচর্চার শুরু। ধর্মের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটেছে। যার কারণে শিল্পী ও স্রষ্টা আর শিল্প ও সৃষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয় করতে কোন সমস্যায় পড়তে হয় না। স্রষ্টার সৃষ্টি-ভাবনা যেমন মৌলিক, ঠিক একইভাবে শিল্পীর শিল্পভাবনাও। যে ভাবনা কারো খেয়াল-খুশিতে তৈরী হয় না, হয় বিশেষ একটা উদ্দেশ্যে। 
.
আদিম মানুষের সমবেত প্রার্থনা, শিকার উৎসব, নৃত্য, সঙ্গীত, কীর্তণ সবই ছিল আরাধনার অংশ। দেব-দেবীর প্রতি আরাধনা। যাদেরকে স্রষ্টা হিসেবে তারা নিজেদের মধ্যে ধারণ করতো। তাদের সাথে যোগাযোগ করার বিচিত্র সব কর্মকাণ্ডে লিপ্ত থাকতো তখনকার ঐ মানুষেরা। তাদের এই আচরণ ও সংস্কৃতি থেকে উন্নতি ঘটে নাটক, গান, নাচ, চিত্রকর্ম, বাদ্যযন্ত্র ইত্যাদির। যেগুলো এক পর্যায়ে শিল্পচর্চার আধার হয়ে উঠে। স্বভাবতই একটা জায়গায় গিয়ে ধর্ম ও শিল্পের একই অবস্থান ল্য করা যায়। সংস্কৃত “ধৃ” ধাতু থেকে ধর্ম কথাটির উৎপত্তি। “ধৃ” অর্থ ধারণ করা। একই সাথে ইংরেজি রিলিজিয়ন শব্দটি উৎপন্ন হয় “রিলিজিও” ধাতু থেকে। যার অর্থ সংযুক্ত করা। এ হিসেবে ধর্ম সংজ্ঞায়িত করলে হয়, ধর্ম এমন একটি ব্যবস্থা যা মানবজাতিকে ব্যক্তি আর সামাজিকভাবে যাবতীয় সুন্দর, সত্য, ভাল, কল্যাণ আর ন্যায়ের মধ্যে ধারণ করবে। পরস্পরকে সংযুক্ত করবে এই মহৎ বৈশিষ্ট্য দ্বারা। শিল্পের ক্ষেত্রেও তাই। যারা ধর্মকে পরিপূর্ণতার সাথে লালন করে তারা ধার্মিক রূপে পরিগণিত হয়। তাহলে শিল্পী কি সেই, যে প্রকৃত ধার্মিক? এ জন্যই কি সঙ্গীতের আদিরূপ কীর্তন (স্রষ্টা বা দেব-দেবীর প্রতি নিবেদিত গান) আর প্রতিটি শিল্পযজ্ঞের শুরুতেই ভিন্ন এক অস্তিত্বের কথা স্মরণ করা হতো? প্রাচীনকাল থেকেই তো পৃথিবীর সকল ধর্মীয় বিশ্বাসের ধর্মীয় স্থাপনাগুলো গড়ে উঠেছে শৈল্পিকরূপে। কালের শিল্পীরা তাদের শিল্পচর্চার শুদ্ধতম প্রয়াস ঘটিয়েছে এসব শিল্পকর্মে। পৃথিবীর অসম্ভব সুন্দরের দৃষ্টান্ত মিশরের পিরামিডের সৃষ্টি তো ভিন্ন এক জগতকে ঘিরেই। যার ল্য শুধু সৌন্দর্য নয়, নান্দনিকতাও নয়। যার কারণে এর রহস্য খুঁজতে গিয়ে দিশেহারা হয়ে যায় সবাই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন