পৃষ্ঠাসমূহ

শিল্পঃ ক্ষুদ্রের জিজ্ঞাসা - ১

শিল্পঃ ক্ষুদ্রের জিজ্ঞাসা - ১ 
মঈদ উদ্দিন তৌহিদ 
১. 
শিল্প এবং সংস্কৃতি হাত ধরাধরি করে চলে। তবে তা সামনের দিকে না পেছনের দিকে এই প্রশ্ন অবান্তর। কারণ সভ্যতার সাথে এদের চলার কোন প্রশ্ন নেই। আমরা কেন এই বিশ্ব সংসারে জীবন যাপন করছি- এ প্রশ্ন সংস্কৃতির আর কিভাবে করছি- এ প্রশ্ন সভ্যতার। একটি জীবনের অর্থ সম্পর্কিত, অন্যটি জীবনের যাপন প্রণালী সম্পর্কিত। যদিও দেশ-কালের ঘটনাগুলি শিল্পকর্মের উপর প্রভাব ফেলে তারপরও যে সংকটগুলি থেকে শিল্প জন্ম নেয় তা আজো বিদ্যমান। অর্থাৎ আজ থেকে দুই হাজার বছর আগেও মানুষের মনে (মানবিক) যে সংকটগুলি ছিল বিভিন্নরূপে সেগুলোই এখনো বিরাজ করছে। বলা হয়ে থাকে, যে পরিবর্তনটা হলো তা হলো সভ্যতার অগ্রগতি। তাহলে উন্নত সভ্যতা ও অনুন্নত সভ্যতার অস্তিত্ব আছে। কিন্তু শিল্পের উন্নত অনুন্নত বলে কিছু নাই। তা হলে বিভেদ রচিত হয়। প্রমথ চৌধুরী বলেছেন যে, সাহিত্য করার অধিকার সকলেরই আছে। এটা শুধু শিতি শ্রেণীর একক অধিকার নয়। যুক্তি, তর্ক, অভিজ্ঞতা, জ্ঞান শিল্প সৃষ্টির জন্য অপরিহার্য নয়। কারণ শিল্পের উৎপত্তি হলো উপলব্ধি থেকে। জ্ঞান দিয়ে তাকে বিচার করা যায় না। তা না হলে (শিল্পের উৎপত্তি উপলব্ধি থেকে না হলে) শিল্পটি অনুকরণে পর্যবসিত হয়। তখন তাকে প্রকৃত শিল্প বলা যায় না। আর যেটা প্রকৃত শিল্প, তা হলো মৌলিক। আর একটা মৌলিক শিল্প হলো অনন্য। এটাকে বিচার করতে হলে এটাকে দিয়েই করতে হবে। এর জন্য অন্য কোন সাপে নেই। ফলে উন্নত বা অনুন্নতার প্রশ্ন এখানে খাটছে না। 
২. 
চেতনাবিহীন শিল্প কখনো পূর্ণতা পায় না। এটা তখন নিছক শিল্পচর্চা হয়। যাকে কলাকৈবল্যবাদ বলে। এ ধরণের শিল্পচর্চার প্রাণ আছে বলে মনে হয় না। একজন শিল্পী সৃজনশীল মানুষ। তিনি সৃষ্টি করতে ভালোবাসেন। তবে তার এ ভালোবাসা শুধু নিজের জন্য না হয়ে যদি অপরের জন্য বা সমাজের জন্য হয় তবেই মঙ্গল। সৃষ্টিকর্তা কোন কিছুই তাঁর নিজের জন্য সৃষ্টি করেননি। তিনি তাঁর সৃষ্টিকে পরম ভালোবাসায় সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু শিল্পী যদি নিজের জন্য বা নিছক প্রয়োজনের তাগিদে বা শিল্পচর্চার জন্য সৃষ্টি করেন তখন তার শিল্প পণ্যে পরিণত হয়। মানুষ তার এ শিল্পকে নিজের প্রয়োজনেই ব্যবহার করে। রবীন্দ্রনাথের অনেক গান বা কবিতাই এখন রমণীদের মন ভোলানোর জন্য ব্যবহৃত হয়। শিল্পীর উদ্দেশ্য (নিয়্যত) তার শিল্পে প্রতিফলিত হয়। নাম যশ খ্যাতি যদি তার শিল্পচর্চার উদ্দেশ্য হয় তাহলে এর শেষ পরিণাম খুব একটা ইতিবাচক হয় বলে মনে হয় না। আর এখানেই শিল্পীর আমিত্বের প্রশ্ন। 
.
শিল্পীর আমিত্ব যদি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠে তাহলে শিল্প তিগ্রস্থ হয়। অর্থাৎ শিল্প তার প্রকৃত পথ থেকে সরে দাঁড়ায়। তাহলে চেতনা সমৃদ্ধ শিল্পই হওয়া উচিৎ একজন শিল্পীর ব্রত। যেখানে তিনি নিজেকে অন্যের মাঝে বিলিয়ে দিয়ে শিল্প রচনা করবেন। 
৩. 
কারা কারা শিল্প করতে পারেন? শিল্পে অধিকার কাদের? আজ এই প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। মাধ্যমটি সৃজনশীল এবং সৃজনশীলদের এ অধিকার আছে বলা যায়। দখলদারিত্বের প্রশ্ন এখানে অবান্তর। কিন্তু দখলদারিত্ব চলছে, প্রভাব বিস্তারের মাধ্যমে, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তির নামে, উন্নত শিল্পের নামে, কাঠামোর নামে, স্কুলের নামে।  
.
একজন শিল্পী শিল্প রচনা করেন তার পরম মমতা দিয়ে, প্রবল আবেগ-অনুভূতি দিয়ে, প্রগাঢ় উপলব্ধি দিয়ে। প্রশ্নটা হচ্ছে, শিল্পরচনা করতে হলে তাকে কাঠামোর শরণাপন্ন হতে হবে কি না। কোন স্কুলের শরণাপন্ন হতে হবে কি না। মোদ্দা কথা সার্থক শিল্পীর স্বীকৃতি পেতে তাঁকে তাঁর মৌলিকতা বিসর্জন দিতে হবে কি না। প্রমথ চৌধুরীর মতে, সাহিত্য (শিল্প) রচনা সমালোচনার ভার যখন শিকদের হাতে এসে পড়তে শুরু করলো তখন সাহিত্যের (শিল্পের) গভীরতা কমতে শুরু করেছে এবং অলঙ্কারশাস্ত্র উৎকর্ষতা পেতে শুরু করেছে। ঠিক যেমন, ইংরেজি, মার্কস, হেগেল, রুশো না জানলে যেমন আমরা শিতি বলে বিবেচিত হই না, তাই স্বীকৃতি পেতে একজন শিল্পীকেও তেমন শিক্ষিত হতে হবে। কিন্তু শিল্প কখনোই এই শিক্ষার উপর নির্ভরশীল নয়। ‘প্রকৃত শিক্ষা (জ্ঞান) কি’? এ প্রশ্ন আমাদের আর বিচলিত করে না। কারণ অর্থনৈতিক (বাজারের) মানদণ্ডে সমাজ তার মানস রচনা করেছে। তাই শিক্ষা (জ্ঞান) যদি এই মানদণ্ডে উৎরে না ওঠে তবে সেই শিক্ষা (জ্ঞান) বিচারের দাবী রাখে না। প্রকৃত আর অপ্রকৃত- সে বিবেচনা তো অনেক দূরের প্রশ্ন। শিল্পের ক্ষেত্রে ও একই কথা প্রযোজ্য।
.
শিল্পের ক্ষেত্রে ও একই কথা প্রযোজ্য। চিন্তা করুন তো একজন অক্ষর বিহীন তীব্র অনুভূতি (যার উপলব্ধিও আছে) সম্পন্ন এক শিল্পীর কথা! তাঁর শিল্পকর্মের মূল্যায়ন কিভাবে ঘটছে বর্তমানে?

1 টি মন্তব্য: