পৃষ্ঠাসমূহ

শিল্পের ধ্বংসে সবাই দায়ী

শিল্পের ধ্বংসে সবাই দায়ী 
সাইফ শাওন
.
শিল্প কি, কেন, কার জন্য ইত্যাদি নানান প্রশ্ন আমাদেরকে নানান ভাবে চিন্তিত করে। এমন কিছু চিন্তা থেকেই কিছু মতের সৃষ্টি। ঠিক তেমনি শিল্পের রূপ নিয়েও অনেকের অনেক মত থাকতে পারে। তবে এ নিয়ে ভাবতে গেলে সকলেই শিল্পস্রষ্টা ও শিল্পভোক্তা নিয়ে ভাবেন। শিল্পস্রষ্টা যে চিন্তা চেতনা দিয়ে তার শিল্প সৃষ্টি করেন, ভোক্তা সেটা ভিন্ন ভাবেও বুঝে নিতে পারেন। এখানেই শিল্পের স্বাধীনতা। আর এতেই শিল্পের সাথে পণ্যের পার্থক্য। পণ্যের কোন স্বাধীনতা বা নিজস্বতা বলে কিছু নেই। ভোক্তা শ্রেণী যেভাবে চাইবে ঠিক সেভাবেই তাকে সাজতে হবে। আবার পণ্যের স্বাদ গন্ধ সবার কাছে একই রকম। স্বাদে বা গন্ধে সামান্য পরিবর্তন আসলেই তা আর বাজার উপযোগী হয়না। শিল্প যার মাঝে প্রবেশ করে তার ভেতরেই নতুন রূপে প্রকাশিত, বিকশিত হয়। ভোক্তা পণ্যকে তার চাহিদা অনুযায়ী সাজায় আর শিল্প তার ভোক্তাকে বিভিন্ন রূপে সাজায়। মানুষের হৃদয়ে শিল্পের উপস্থিতি ঐশ্বরিক। এই উপস্থিতি শিল্প-স্রষ্টা, শিল্প-ভোক্তা এবং শিল্প-মাধ্যম (পারফর্মিং আর্টসের ক্ষেত্রে শিল্পী)-এর কাছে ভিন্নরকম। অর্থাৎ প্রত্যেকের কাছেই তা ভিন্ন রূপে ধরা দেয়। আর এজন্যই শিল্পস্রষ্টার হৃদয়ে শিল্পের উপস্থিতি ঘটলে তার প্রকাশ কখনো কবিতা, কখনো গান আবার কখনো চিত্রের মাধ্যমে হয়ে থাকে। শিল্প আর পণ্যের পার্থক্য যে স্রষ্টা বুঝতে পারেন না, তার শিল্প কোন কারণ ব্যতীতই পণ্যে পরিণত হয়।
.
শিল্প হলো লাগামহীন ঘোড়ার মতো। যেদিকে খুশি যাওয়ার স্বাধীনতা আছে। স্রষ্টার চোখে সে একরকম আর ভোক্তা বা দর্শকের চোখে অন্যরকম হলেও কোন আপত্তি নেই। তবে যদি কোন ভাবে দুটো চোখেই সমান হয় তাহলে আমরা তাকে সার্থক শিল্প বলি। কেননা শিল্প-স্রষ্টা আর শিল্প-ভোক্তার মিলনের মধ্য দিয়েই শিল্পের সার্থকতা ফুটে উঠে। এই দুই পরে চিন্তা ও ভাবের মিলন ঘটানো এতটা সহজ কাজ না। কারণ শিল্পের একটা নিজস্বতা আছে, আর ব্যক্তি বা ভাবনার দিক থেকে এটা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই শিল্প স্রষ্টার চিন্তা থেকে কোন মাধ্যম দিয়ে ভোক্তার কাছে যাওয়ার পথে এর রূপ বদলে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আর এতে কারো কোন আপত্তি থাকে না। কেননা বহুমাত্রিক রূপ থাকলেই তাকে শিল্প বলা চলে। ত্রে, অবস্থান, পরিবেশ, মাধ্যম ইত্যাদির পরিবর্তন ঘটলে শিল্পের অর্থেরও ব্যাপক পরিবর্তন ঘটে। তাই শিল্প সার্বজনীন এবং স্থায়ী। 
.
স্রষ্টা আর ভোক্তার মাঝে যে সংযোগ সড়কের প্রয়োজন তার ভূমিকায় থাকেন একজন শিল্পী (পারফর্মিং আর্টসের ক্ষেত্রে, আবার চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রে ক্যানভাসটা মাধ্যম)। শিল্পীর মাধ্যমেই স্রষ্টা তার শিল্পকে ভোক্তার কাছে প্রকাশ করেন। আবার কখনো কখনো স্রষ্টা নিজেই শিল্পী হয়ে তার শিল্পের প্রকাশ ঘটান। একই শিল্প যদি ভিন্ন ভিন্ন শিল্পীর দ্বারা প্রকাশ করা হয় তাহলে এর বিভিন্ন রূপ ফুটে উঠবে। কারণ শিল্পের রূপ বহুবিচিত্র। তাই তাকে কারো উপর (শিল্পী, মঞ্চ, পরিবেশ, ভোক্তা ইত্যাদি) নির্ভর করতে হয় না। এমন কি স্রষ্টার উপরও না। স্রষ্টা চাইলেই শিল্পের বৈচিত্রময়তার সাগর থেকে যে কোন একটা রূপ নিয়ে তা ভোক্তার কাছে প্রকাশ করতে পারেন। আর স্রষ্টা কোন রূপটি বেছে নিবেন তা স্রষ্টার রুচি, জ্ঞান ও ব্যক্তিত্বের উপর নির্ভর করে। কোন নাটক বা সিনেমায় একটা ধর্ষণের দৃশ্য অনেক কিছুই নির্দেশ করে। নির্মাতার দিক থেকে চিন্তা করলে বলতে হবে, তার সাজানোর ধরণটা কেমন? যদি এতে সমাজের বিশৃংখলা প্রকাশ পায় তাহলে একরকম আর যদি নারীর উপর পুরুষের নির্যাতন বুঝায় তাহলে অন্যরকম। আবার যদি নির্মাতা শুধুমাত্র একটা নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শকের কথা ভাবেন (যারা শুধু এ দৃশ্যটি উপভোগ করার জন্য সেই শিল্পকর্ম দেখতে আসবেন) তাহলে এর নির্মাণ ভিন্ন রকম হতে পারে। এখানেই স্রষ্টার রুচি, জ্ঞান আর ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটে। আর তাই বলা যায় শিল্পের প্রয়োজনীয় ও সুন্দর রূপের প্রকাশটা স্রষ্টার উপরেই নির্ভর করে। স্রষ্টা চাইলে ভোক্তাকে অনেক ক্ষেত্রে পরিপাটি করতে পারেন।
.
স্রষ্টা যে শিল্প সৃষ্টি করেন, তা দর্শকের কাছে পৌঁছানো বর্তমানে খুব বেশি কঠিন কাজ নয়। দর্শক শ্রেণী কতটা পরিপাটি তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। সঠিক শিল্পের সৃষ্টিতে পরিপাটি দর্শক শ্রেণী তৈরী হয় একথা যেমন সত্য তেমনি সত্য হল পরিপাটি দর্শক থাকলে সঠিক শিল্প তৈরী হবেই। তবে পরিপাটি শিল্পের সৃষ্টিতে আজও মানুষ আনন্দ পায়। সংখ্যায় কম হলেও এদের আগ্রহ ও উপস্থিতি অনেক শক্তিশালী ভূমিকা রাখে বলেই আজও আমরা সুস্থ শিল্পের ছোঁয়া পাই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে কয়জন স্রষ্টা তার তৈরী শিল্পের নান্দনিকতার দিকে চোখ রাখেন? আর কয়জন শুধুমাত্র একটি নির্দিষ্ট শ্রেণীর দর্শককে সন্তুষ্ট করা ও সাময়িক আনন্দ দিয়ে ব্যবসা সফল শিল্প তৈরীতে ব্যস্ত থাকেন। আমরা সবাই জানি, আদমশুমারী করলে হয়তো ব্যবসায়ী মনের স্রষ্টার সংখ্যাই বেশি পাওয়া যাবে। তারা স্রষ্টার কস্টিউম পরে মঞ্চে প্রবেশ করে আর মৃত্যুদূতের অভিনয় করে শিল্পের ধ্বংসস্তুপ তৈরী করে বেড়ায় প্রতিটি শহরে। এজন্য শুধু তারাই দায়ী নয়। এক্ষেত্রে ভোক্তা, পৃষ্ঠপোষক, শিল্পী সকলেই সমান ধারার আসামী। মাঝে মধ্যে সমালোচনাকারী বুদ্ধিজীবী শ্রেণীকেও ভিন্ন ধারার কেউ মনে হয় না। একটি শিল্প যদি পণ্যে পরিণত হয় তাহলে এর দায় ভার যেমন শিল্পস্রষ্টার উপর বর্তায় ঠিক তেমনি শিল্পের সঙ্গে জড়িত অন্যান্য সকলেও চাইলেই এর দায় এড়িয়ে যেতে পারে না। কেননা সকলে মিলেই শিল্পের লালন পালন করতে হয়। অন্যথায় শিল্পের ধ্বংস নেমে আসে।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন